বিসর্জন - শামিম ইশতিয়াক
চোখ বন্ধ করে অলস দেহ নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল নুহান, আজ আটত্রিশ দিন হলো ঘরে বন্দী সে, শুধু সে বন্দী নয়, বন্দী হয়ে আছে তার পরিবার, এলাকার মানুষ, ও সারাদশের মানুষ।
নুহান শহরের একটি সরকারি কলেজের অর্থনীতিতে অনার্সের ছাত্র, করোনা ভাইরাসের জন্য সারাদেশে সরকারি ছুটি ঘোষণার পর সে গ্রামে চলে আসে, থাকত একটি মেসে, বন্ধু বান্ধব হৈ-হোল্লা, আড্ডাবাজি, রাতে মন দিয়ে পড়াশুনা এই নিয়ে ছিলো তার জীবন অথচ এখন সকাল বিকেল শুয়ে বসে থেকে বই পড়া ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করেই অলস সময় কাটে তার।
পুটিং.. মেসেঞ্জারের এলার্টে ফোন হাতে নিল নুহান, বন্ধুদের নিয়ে মেসেঞ্জারে তার একটি গ্রুপ আছে তাতেই মেসেজ দিল জুবায়ের "কি করছিস সবাই?" নুহান রিপ্লে করে কনভারসেশন চালিয়ে যাচ্ছিলো হঠাৎ খেয়াল করলো ফারাবি মেসেজ দেখছে অথচ কোন কথা বলছেনা, নুহানের ভাবনায় ফারাবি এসে ধরা দিলো, সে খেয়াল করছে বেশ কিছুদিন হলো ফারাবি ফেইসবুকে কোন স্টেটাস আপডেট করছেনা অথচ ছেলেটার ফেইসবুকে স্টেটাসের জন্য তাকে আনফলো করতে চেয়েছিল সে, তাছাড়াও মেসেঞ্জারে অযথা মেসেজ দিয়েও বিরক্ত করত।বন্দী জীবনে সবার কথা মাথায় আসলেও ফারাবির কথা মাথায় আসেনি নুহানের, হলো কি ছেলেটার জানতে নাম্বার প্যাড ডায়াল করে ফোন দিল,
নুহান- কিরে মামা কি খবর?
ফারাবি- ভালো তর কি খবর?
- আলহামদুলিল্লাহ, বন্দী থেকে তর মাথাও গেছে নাকি রে? আজকাল কোন স্টেটাস দিচ্ছিস না,
- নারে এমনিতে ভালো লাগেনা আজকাল,
- ছ্যাকা খেয়েছিস বুঝি? হা হা হা
- না রে, এমনি, আচ্ছা রেখে দেই রে নুহান ভালো থাকিস,
বলে ফোন রেখে দিল ফারাবি, কেমন যেন সন্দেহ হলো নুহানের, ফারাবি এমন নয়, সে অন্তত এভাবে কথা বলেনা কখনো, বড় রকমের কোন সমস্যা হয়েছে তার আচ করতে পারল নুহান। নুহান একে একে সব বন্ধুদের সাথে শেয়ার করল বিষয়টা, কেউ সিরিয়াসলি নিলো কেউ হেসে উড়িয়ে দিল, কিন্তু নুহানের মাথা থেকে যেনো কোনভাবেই নামছিলোনা ব্যাপারটা, চিন্তায় মগ্ন হয়ে কেটে গেলো তার কোয়ারান্টাইন এর আরো একটা দিন।
পরদিন ভোরে সূর্য উঠল, সুস্থ পৃথিবীর সুর্যের অপেক্ষায় থাকা নুহান সূর্য দেখতে বাড়ির পাশের খালি মাঠে চলে আসল, উদাস হয়ে আকাশ ভেদ করা সূর্য দেখতে থাকা নুনাহের হঠাৎ মনে হয়ে গেলো ফারাবির কথা, আজকে জানতেই হবে কি হলো হাসিখুশি থাকা এই ছেলেটার, কি করা যায় ভেবে একটা উপায় খুজে বের করল সে, ফেইসবুকে ফারাবির একাউন্ট থেকে ফ্যামিলি মেম্বারে থাকা কয়েকজনের মাঝে একজন কে মেসেজ দিয়ে অপেক্ষায় থাকলো উত্তরের, সারাদিন প্রায় কেটে গেলো উত্তরের অপেক্ষায় অবশেষে সন্ধায় উত্তর আসলো, পরিচয়প্রদান ও আলাপচারিতায় সে জানতে চাইল ফারাবির কথা, ছেলেটি জানাল ফারাবি আর তার পরিবারের অবস্থার কথা শুনে নিজের অজান্তেই চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো নুহানের।
ফারাবির ক্ষুদ্রব্যাবসায়ী বাবার ব্যাবসা এখন বন্ধ, নারায়নগঞ্জে থাকা ছোট্ট দোনাক বন্ধ করে চলে এসেছে গ্রামে, যে দোকান থেকেই আসতো পরিবারের ভরনপোষণ, ফারাবির ও তার ছোট বোনের পড়ালেখার খরচ, অথচ এখন দোকান বন্ধ, নেই জমানো সঞ্চয়, তিনবেলা থেকে এখন দু'বেলা দুমুঠো ভাত খেতেই হিমসিম খেতে হচ্ছে ফারাবিদের, মধ্যবিত্ত হওয়ার কারো কাছে হাত পাততেও লজ্জা পাচ্ছে, বুকের ভেতরটা কেমন যেনো ফাকা হয়ে গেলো নুহানের, কাছের বন্ধুর পরিবারের এমন অবস্থা অথচ তাকেও জানতে বুঝতে দিলনা সে, কিছুটা একটা করতে হবে এই প্রত্যয়ে ঘুমাতে গেলো ফারাবি।
পরদিন সব বন্ধুদের সাথে শেয়ার করল, কিছু একটা করতে হবে ফারাবিদের জন্য, ছেলেটা না খেয়ে মরলেও কখনো কাওকে জানাতে আসবেনা, সবাই সাড়া দিল, একদিনেই সবাই বিকাশে টাকা দিল, কিন্তু সব টাকা হিসাব করে নুহান দেখল অতি সামান্য টাকা যা দিয়ে নুহানদের পরিবারের ৭দিনের ভরনপোষণ ও হবেনা, চিন্তায় মগ্ন হয়ে উঠলো নুহান, কিছু একটা করতেই হবে, কাছের বন্ধুর দুঃসময়ে পাশেই যদি না থাকে তাহলে কি লাভ এই বন্ধুত্বের? নিজের বিবেকের কাছে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিল নুহান।
ভাবনায় অস্থির হয়ে গেলো নুহান, চারদিন কেটে গেলো, নুহানের খাওয়া ঘুম যেন পূর্ণতা হারিয়েছে, ঘরের চঞ্চলতা হারানো নুহানকে মনে হতে লাগলো জড়পদার্থের মত, মা বাবা চিন্তায় পড়ে গেলো তাকে নিয়ে, ৬মাস আগে নুহানের বাবা নুহানকে ল্যাপটপ কিনে দেওয়ার কথা বলেছিল, নুহান বলে রেখেছিল যে কোন দিন টাকা নিবে, আজ সে সাহস করে বাবার সামনে দাড়ালো নির্দ্বিধায় টাকা চাইল ল্যাপটপের, নুহানের বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ছেলের দিকে, ল্যাপটপ কিনার জন্যেই এমন মনমরা হয়ে উঠেছে ছেলেটা, কোন রকমে নুহানের বাবা বলব এখন ত লকডাউন দোকানপাট বন্ধ এখন কিভাবে কিনবা বাবা? পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক আমি সাথে গিয়ে কিনে দিব, এখন যাও ল্যাপটপের ভূত মাথা থেকে নামিয়ে পড়াশুনায় মন দাও, নুহানের বাবার এক কথা মানেই পরিবারের সবার কাছে গ্রহনযোগ্য, তাই দ্বিতীয়বার চাইবার সাহস না করেই রুমে চলে গেলো সে।
পরদিন নুহান সব কিছু শেয়ার করল তার মায়ের কাছে, বলল আমি ল্যাপটপ চাইনা, আমার বন্ধু ফারাবির পরিবারের অবস্থা খারাপ আমি সব টাকা তাদের দিয়ে দিতে চাই, সব শুনে নুহানের মা একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললো, ছেলের এমন পাগলামি নতুন নয়, বলল আচ্ছা তর বাবাকে আমি বলব।
পরদিন সকালে নুহানের বাবা তাকে টাকা দিল,নুহান যেনো টাকা নিয়ে স্থির হতে পাচ্ছেনা, কোনভাবে টাকাগুলো নিয়ে বাজারে চলে গেলো ফারাবির ডাচবাংলা ব্যাংক একাউন্টে টাকাগুলো পাঠিয়ে ফারাবিকে মেসেজ দিল "ওই হাদারাম টাকাগুলো আংকেলের হাতে বুঝিয়ে দিবি, আর হ্যাঁ আজকের পর থেকে ফেইসবুক স্টেটাস না পেলে তর বারোটা বাজাবো আমি, আর কখনো এমনি কিছুনা বললে তর মত বন্ধুর সাথে মিশব না কিন্তু মামা"
ফারাবির একের পর একে ফোনকল আর মেসেজ আসছে নুহানের ফোনে, নুহান রিসিভ করতে দ্বিধায় ভুগছে, না জানি বন্ধু তার পাঠানো টাকার কৃতজ্ঞতা স্বীকারে ছোট হয়ে যায়, তাই ফোন সাইলেন্ট মুডে ফেলে টেবিলে রেখে অন্যরকম এক প্রশান্তি নিয়ে সুস্থ পৃথিবীর নতুন সূর্য দেখার অপেক্ষায় লম্বা ঘুম দিল নুহান।
শামিম ইশতিয়াক
শিক্ষার্থী, আনন্দ মোহন কলেজ ময়মনসিংহ
কলেজ রোড, সদর, ময়মনসিংহ
এখনও কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্যটি করুন!