নৈতিক অবক্ষয়ের সূচনা - মোঃ আইনাল হক

প্রকাশিত হয়েছে : জুন ১৫, ২০২৩ | দেখা হয়েছে: ১২৯৭ বার
নৈতিক অবক্ষয়ের সূচনা - মোঃ আইনাল হক

কদিন এক পাওনাদার ধারের টাকা নিতে দেনাদারের বাড়ি এলেন। পাওনা টাকা চেয়ে তাগাদা দিতে লাগলেন।  ভীষন ডাকাডাকির এক পর্যায়ে দেনাদার তার ছেলেকে বলে পাঠালেন, "গিয়ে বলো, বাবা বাড়ি নেই।" শিশু ছেলের মন তা তো মিথ্যা জানে না, বুঝেও না প্রতারণা কি। সে বাইরে এসে আগন্তুক কে বলল, "বাবা বললেন, বাবা বাড়ি নেই।" তাৎপর্য কি দাঁড়াল? আসলে আমরা নিজেদের অজান্তেই প্রজন্মের প্রতি অবিচার করছি। পরিচালনা করছি ভুল পথে। তাদের সঠিক শিক্ষা দিতে অপারগতার এ দায়ভার কার? গল্পে বর্ণিত শিশুটি তার জন্মদাতা পিতার কাছ থেকে আস্তে আস্তে মিথ্যা শিখছে। কিভাবে প্রতারণা করতে হয় তা হাতে কলমে প্রয়োগ করতে দেখছে। একটি শিশু সমাজ থেকে পাওয়া কালচারেই বেড়ে উঠবে, নৈতিকতা শিখবে, হৃদয়বান হবে, সৎ চরিত্রবান হয়ে দেশ ও দশের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করবে- এটিই স্বাভাবিক। সেই আলোর দীশারি সমাজ-ই যদি নৈতিকতার বিপরীত শেখায়, মিথ্যার কালচারে অভ্যস্ত করে, তবে জাতি এ অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে কিভাবে?

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যারা দেশমাতৃকার জন্য অকুতোভয়ে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে জাতিকে রক্ষা করবে, জাতির দুর্দিনে পাশে দাঁড়াবে, দেশপ্রেমে বলিয়ান হয়ে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে, সর্বোপরি স্বাধীন ও সার্বভৌম এ দেশকে দূরদর্শিতার সাথে  যুগে যুগে পৃথিবীর মানচিত্রে টিকিয়ে রাখবে; তারাই যদি মেধা ও মননের ব্যবহার বাদ দিয়ে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে মানুষ গড়ার কারিগরদের সার্বিক ও সার্বক্ষণিক তত্বাবধানের মাধ্যমে একটি সার্টিফিকেটের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে উঠে তখন আসলে আমরা কোন পথে হাঁটছি? যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের নীতি ও নৈতিকতা শিখিয়ে দায়িত্বশীল, হৃদয়বান সম্পূর্ণ মানবিক মানুষ রূপে গড়ে তোলা, মেধা ও মননের সর্বোচ্চ ব্যবহার শিখিয়ে জাতির তথা মানুষের সেবা করা; সেখানে তারা যদি নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে অনৈতিকতা শেখে, অসদুপায় অবলম্বনের দীক্ষা পায় এবং তা পরবর্তী জীবনে প্রয়োগ করে তবে এ ব্যর্থতার দায় কার উপর বর্তায়? 

একজন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জনৈক এক সদস্য মুখে সিগারেট ধরিয়ে পাবলিক প্লেসে পোস্টার সাঁটাচ্ছেন, তাতে লেখা "ধুমপান করলে ৫০ টাকা জরিমানা"। এরকম আদর্শ নিয়ে ক্যামনে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পরিশুদ্ধ ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা করা যায়! নৈতিকতার অবক্ষয় প্রতিরোধের এ শিক্ষা আমরা ভুল শিক্ষার মাধ্যমে দিচ্ছি না তো!

মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিক শিক্ষা, শিষ্টাচার, নীতি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, ধর্মীয় অনুভূতি এ মহামূল্যবান অপার্থিব বস্তুগুলো সভ্য জাতি গঠনে আবশ্যিক নিয়ামক স্বরূপ। যাদের এসব মানদণ্ডের পারদ উপরে, পৃথিবীর মানচিত্রে তারাই সভ্য দেশ হিসেবে লিড দিচ্ছে। বিশ্বকে ভালোর পথে পরিচালনার প্রচেষ্টা করছে। কলুষিত সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে নৈতিকতা বিবর্জিত, ধর্মীয় অনুশাসনহীন, অসভ্য ও সংস্কৃতির চর্চা বিহীন জাতিকে আলোকবর্তিকা হাতে নিজেদের দিকে ডাকছে। কিন্তু যদি এর উল্টােটা ঘটে?

যদি মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়, অনৈতিকতা গ্রাস করে সমাজের স্তর, শিষ্টাচার বহির্ভূত শিক্ষা-সম্পর্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, দূর্নীতির মহোৎসবে মেতে উঠে জাতি, চারিত্রিক কদর্যতায় ঢাকা পড়ে জীবন, ধর্মীয় অনুভূতির বিনাশ হয়, রঙিন নেশার বানে প্লাবিত হয় ভবিষ্যত প্রজন্ম, জাতিসত্তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যে নিজস্ব উপলব্ধিহীনতা বিলুপ্ত হয়, তবে সে জাতির ভবিষ্যৎ কোথায়?

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, 'Charity begans at home'. আসলেও তাই, আমাদের সমস্ত সৌজন্যতার শিক্ষা পরিবার থেকে শুরু হওয়া উচিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সৎ সাহস শেখাতে হবে। শেখাতে হবে কিভাবে বিপর্যয়ের মুখে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হয়, ধৈর্য্য ধারণ করতে হয়। কিভাবে বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করতে হয়, হতে হয় শিক্ষকদের প্রতি আনুগত্যশীল। শিশুদের কল্যাণকর সৃজনশীল সত্তার বিকাশ ঘটাতে হবে।  এ ক্ষেত্রে পরিবার হবে নৈতিক শিক্ষা প্রদানের সবচেয়ে বড় শিক্ষক।  এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও কবি আহমেদ ছফা বলেছেন, "সৎ সাহস জেঠামি নয়, সৎ সাহস হচ্ছে অনেক দূরবর্তী সম্ভাবনা দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা"। পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নৈতিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে নৈতিকতার অবক্ষয় রোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। যেহেতু এটি একটি আপেক্ষিক বিষয়, তাই ধর্মীয় অনুশাসন এবং নৈতিক শিক্ষায় উন্নত করে প্রজন্মের ভিতরে উত্তম আদর্শের বীজ বপনের মাধ্যমে দেশ ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এর অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব। 

মোঃ আইনাল হক 
রাজশাহী, বাংলাদেশ 

শেয়ার করুন:
মন্তব্যসমূহ (0)
আপনার ইমেইল প্রকাশ করা হবে না। যেসব ঘর পূরণ করা বাধ্যতামূলক, সেগুলোতে * চিহ্ন দেওয়া আছে।

এখনও কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্যটি করুন!

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন