শাড়ি, সংস্কৃতি এবং আমাদের মূল্যবোধ - ফরিদ তালুকদার
ঢাকাই জামদানী, রাজশাহী সিল্ক, তসর সিল্ক, মহীশুর সিল্ক, বানারসি, সাউথ ইন্ডিয়ান কাতান, মনিপুরী শাড়ি, টাঙ্গাইল–পাবনা তাঁতের শাড়ি এবং এমন আরও অনেক নামের সাথে পরিচিত নয়, বঙ্গীয় তথা ভারত উপমহাদেশে এমন একটি লোক এমনকি সদ্য কথা বলতে শিখেছে এমন একটি শিশুও হয়তো খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। শাড়ি..। একটি নাম, একটি শব্দ..। জড়িয়ে আছে আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি, আমাদের জীবন প্রবাহ, আমাদের আবেগ, সুখ-দুঃখ–বেদনার অংগে অংগে। আর তাই, এই শাড়িকে নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর, কিছুটা অন্তর্গত সত্যের খোঁড়াখুঁড়ি।
খৃষ্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে ভারত উপমহাদেশে প্রথম সুতার চাষ শুরু হয়। আর ইতিহাস মতে এই প্রবন্ধের প্রধান উপজীব্য শাড়ি, বাংলা তথা আধুনিক ভারতীয় ভাষায় (In Bengali and modern Indian languages), সাটি, সংস্কৃতে (Sati in Sanskrit), সাডি, পালিতে (Sadi in Pali), এর প্রথম ব্যবহার দেখা যায় আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ২৮০০ – ১৮০০ সালে, সিন্ধু নদের তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতায় (Indus valley civilization)। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত এই “শাড়ি” শব্দটি নারীদের জন্যে পরিধেয় বুঝাতে পূরণ সংস্কৃতে ব্যবহৃত শব্দ “সাট্টিকা” (Sattika) এবং বৌদ্ধ সাহিত্যে ব্যবহৃত জাতাকাস ( Jatakas ) শব্দের ই সমার্থক একটি শব্দ। আমাদের হাজার বছরের জীবন প্রবাহের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত ১৮ ফুট X ৪ ফুট গড়পড়তা আকৃতির এই পরিধেয় টুকুর উৎপত্তি, বিবর্তন এবং একে নিয়ে যেসব গবেষণা, গল্প-উপন্যাস, কাব্য-কথা, সংগীত হয়েছে এবং হচ্ছে তার কিঞ্চিৎ বর্ণনা–ব্যাখ্যায় গেলে এ প্রবন্ধ কখনো তার শেষের লাইনে পৌঁছাতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। সুতরাং সে পথে না হেঁটে লেখার মূখ্য উদ্দেশ্যর কাছাকাছি যাওয়া যায় কিনা সে চেষ্টা করা যাক। তবে একটা কথা এখানেই বলে নেয়া ভালো যে, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের পরিধেয় হিসেবে আজকে আমরা যে শাড়ি, পেটিকোট এবং ব্লাউজের (আজকের আলোচনায় পেটিকোট এবং ব্লাউজকে নিয়ে তেমন ব্যাখ্যায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই। ধরে নিব শাড়ির যে কোন উল্লেখে এ দুটো পরিধেয় সম্পূরক হিসেবে আসবে) এই নান্দনিক সমন্বয় দেখি তা এক ধারাবাহিক বিবর্তনের ই ফসল। মনোহারিণী এই পোশাক একদিনে হঠাৎ করে আবিস্কৃত কোন কিছু নয় বা পোশাক শিল্প নিয়ে গবেষণা করা অতি মেধাবী কোন ডিজাইনারের কোন ফ্লুক (Fluke) আবিস্কার বলেও জানা যায় না।
কোন দেশ, জাতি বা জনগোষ্ঠীর পোশাক পরিচ্ছদ এবং সৌন্দর্য বোধ সেই জনগোষ্ঠীর হাজার বছরে বেড়ে ওঠা সংস্কৃতির ই স্বাক্ষর বহন করে। ভৌগোলিক অবস্হান, আবহাওয়া, জলবায়ু, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের মত বিষয়গুলোই মূলত এই পোশাক সংস্কৃতির মূল ধারার গতি নির্ধারক হয়। একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর সব মানুষের মধ্যে এই সৌন্দর্য বোধের বিষয়ে একটা সাধারণ অন্তমিল থাকলেও প্রকৃত পক্ষে এটি প্রতিটি মানুষের ই সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাপার। নির্দিষ্ট কোন মাপকাঠি দিয়ে কোন সাধারণ সূত্রে একে ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ এটি আমাদের আবেগের সাথে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত। আর মানুষ তথা প্রতিটা প্রাণীর আবেগে যেমন রয়েছে ভিন্নতা তেমনি স্হান কাল পাত্র ভেদে একজন মানুষের আবেগের প্রকাশ রূপ ও ভিন্ন হয়ে থাকে। আরও পরিস্কার করে বললে বলতে হয়, আজ সকালে যে গানটি আমার ভালো লেগেছে সেই একই গান সন্ধ্যাবেলা যে আমার ভালো লাগবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই । সে হিসেবে বলা যায়, একটি সাধারণ অনুভূতি এবং ব্যাখ্যার আওতায় সব সুন্দরকে আনা গেলেও কোন সুন্দর ই একটি সার্বজনীন শাশ্বত রূপ নিয়ে কালজয়ী হয় না। বহুরূপী আমাদের এই পৃথিবী এবং বহুরূপী এই প্রকৃতির সৌন্দর্য। তারই একটি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশ হলো আমাদের নর-নারীর মন, তাদের চিন্তা চেতনা এবং দৈহিক সৌন্দর্য। প্রবন্ধের প্রয়োজনে আরও নির্দিষ্ট করে বলতে হয় তরুণ–তরুণী এবং যুবক-যুবতীর মানসিক এবং দৈহিক সৌন্দর্য। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই এই সৌন্দর্যের দ্বারা আমরা একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হই। কখনো কখনো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার মত আকৃষ্ট হই। কোন পরিসংখ্যান নেই, তবে আমার ধারণা আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত শিল্প, সাহিত্য, সংগীতের সৃষ্টি হয়েছে তার প্রায় শতভাগের পেছনেই রয়েছে নর–নারীর মাঝে এই ভালোলাগা এবং বিরহ মিলনের গাঁথা। ভবিষ্যতে ও যে এ ধারা অব্যাহত থাকবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। শুধু শিল্প সাহিত্য ই নয়, অনেক যুদ্ধ বিগ্রহের কারনের পিছনে ও রয়েছে এই ভালোবাসাবাসির উপাখ্যান..! ভালোবাসার মানুষ কে নিয়ে এই হৃদয় আকুতির তীব্রতা কোন পক্ষে ভারী তা কখনো হয়তো বিশেষ যুগলের উপর নির্ভর করে অথবা এটা নির্ধারণের দায়িত্ব স্বয়ং বিধাতার উপরে ছেড়ে দেয়াই নিরাপদ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো পৃথিবীর তাবৎ শিল্প, সাহিত্য, সংগীতের দিকে তাকালে দেখা যায় হৃদয়ের এই মর্মকথা প্রকাশের ক্ষেত্রে নারীদের চেয়ে পুরুষেরা অনেক অনেক গুন বেশী এগিয়ে। কারণ..? হয়তো প্রকৃতি নারী হৃদয়কে এমন করেই সৃষ্টি করেছে। হৃদয় সরোবরে সারাক্ষণ আবেগের ধূম্রজাল শুধু জ্বালিয়ে রেখেই তারা খুশী হয়, যেখানে পুরুষেরা লাভার উদগীরণের মতই শত ধারায় এর প্রকাশ ঘটায়। অথবা সৃষ্টির আদি থেকে আজ অবধি পুরুষ শাষিত এই সমাজের অবদমনে থাকতে থাকতে তাদের জিন ক্রোমোজমের মধ্যেই এমন বিবর্তন ঘটে গেছে..! বিষয়টাকে এ মুহূর্তে আমি জেনেটিক বিজ্ঞানীদের হাতে ছেড়ে দিলাম। গত শতক দু’শতক ধরে তাদের অধিকারের বিষয়টি (বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে) বাতাসে একটু আধটু ঢেউ তুললেও এই একই সময়ে মানবিক এই অনুভূতির (অন্তত মৌখিক স্বীকৃতিটুকুর) সমান্তরালে একই গতিতে বেড়ে চলেছে বাজার অর্থনীতির কালো ঘোড়া। ফলশ্রুতি..? পুঁজির হিংস্র থাবা শুধু যে আমাদের সুকুমার বৃত্তিকে খেয়ে ফেলছে তা ই নয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আবারও নারীদের ঠিকানা হয়ে যাচ্ছে সেই ভোগ্য পন্যের কাতারে। এদের মধ্যে কিছু হয়তো স্বইচ্ছায়, তবে বেশীর ভাগই টিকে থাকার অনিবার্য যুদ্ধে বাধ্য হয়ে। দিবস আমরা যতই পালন করি না কেন, সংস্থা আমরা যতই সৃষ্টি করি না কেন, মহাকাশে রকেট যতই পাঠাইনা কেন, যদি বলি মানবতাই প্রকৃত সভ্যাতার মাপকাঠি (নারীদের ন্যায্য অধিকার, প্রকৃত অর্থেই সমান এবং সন্মান জনক অবস্থান তার জন্যে অপরিহার্য শর্ত) তাহলে রাডারে (Radar) আমাদের অবস্থান মধ্যযুগীয় সীমান্ত থেকে বড়জোর দু'হাত দূরে। বর্তমান পৃথিবীর সমাজ চিত্র থেকে নিমেষে একশো উদাহরণ এনে এ কথার যথার্থতা প্রমান করা যায়। পুরুষ শাসিত সমাজে, পুঁজি শাসিত সমাজে, ধর্মীয় কূপমন্ডুকতায় আবিষ্ট এই সমাজে এর চেয়ে আর কি ই বা বেশী আশা করা যায়..!?
দুঃখিত, ভুলেই গিয়েছিলাম যে আজকের প্রবন্ধের প্রধান চরিত্র শাড়ি। শাড়ি.. বিখ্যাত শাড়ি বঙ্গীয় মাধ্যম গুলোতে হঠাৎ করে আবারও জায়গা নিয়ে নিলো সম্প্রতি একে নিয়ে লেখা শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলার সুস্হ সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিরলস সংগঠক আবদুল্লাহ আবু সাইদ স্যারের একটি প্রবন্ধ। প্রবন্ধটি আমি বার দুয়েক পড়েছি। চমৎকার শব্দের গাঁথুনিতে গড়ে ওঠা প্রবন্ধ অবয়বে উল্লেখিত বেশ কয়েকটি বিষয়ের সাথে আমি যে শুধু সহমত পোষণ করি তা নয় ভালোও লেগেছে। যেমন ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের সৌন্দর্যকে আর একটি মাত্রায় নিয়ে যেতে শাড়ি যে একটি অনন্য পরিধেয় তা নিয়ে হয়তো কারোরই দ্বিমত নেই। আর একটি বিষয়, যেটা আমার সব সময়ই মনে হতো তা হলো, এই উপমহাদেশের নারীদের অনির্বচনীয় লাবন্যের সাথে শাড়ির সম্মিলন যে অপূর্ব মোহময়তার সৃষ্টি করে, দৈহিক গড়নে আরও আকর্ষণীয় হওয়ার পড়েও ইউরোপীয় বা আফ্রিকান রমনীদের অংগে তা তেমন মোহনীয় হয়ে উঠবে না। তিনি এটাও সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। স্বীকার করি আর না করি, শাড়ি যে বঙ্গীয় রমনীদের যৌনাবেদনময়ী করে তোলে তাও সত্যি। এবং যৌবনের শিখরে থেকে আমরা যখন রমনী সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে যৌন আবেদন যে তাতে একটা অনুসংগ হিসেবে কাজ করে তা স্বীকার করতে হবে। কোন পুরুষ যদি এটাকে অস্বীকার করে তাহলে তার সত্য বচন নিয়ে প্রশ্ন জাগে। বিষয়টা নারীদের দৃষ্টি কোন থেকে দেখলেও হয়তো একই। কিন্তু ঐ যে বললাম, তাদের ক্ষেত্রে এটা সেই অপ্রকাশিত প্রচ্ছদের নীচেই চাপা পড়ে থাকে। এই সব সত্যকে স্বীকার করেও যতই প্রবন্ধটির শেষের পথে হাঁটতে থাকি তখন এর কিছু কিছু বিষয়ে আরও একটু দৃষ্টির প্রসারতা বা ব্যাখ্যা আশা করি। বিশেষ করে নারী পুরুষের সৌন্দর্য নিরুপণে তিনি যখন দৈহিক আকৃতির বিষয়টি নিয়ে আসেন এবং রবীন্দ্রনাথেরও একটি উক্তিকে উদৃত করেন। বিষয়টাকে স্বীকার করেও আমি এর কারনটা একটুখানি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। এটা ঠিক যে ‘আগে দর্শনারী পরে গুন বিচারী'। তারপরও বলবো মানুষের সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে দৈহিক গড়ন গুরুত্বপূর্ণ হলেও একমাত্র বিষয় নয়। এর সাথে আর্থ সামাজিক স্বচছলতা, তার অন্তরাত্মা, তার চিন্তা চেতনা এবং মেধার চর্চার সমন্বয়েই প্রকৃত সৌন্দর্য ফুঁটে ওঠে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ বা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের গড় পড়তা ব্রিটিশদের মেধা ও মনন আর আমাদের বঙ্গীয় সমাজের মানুষের মগজ চর্চার মাঝে বিশাল ব্যবধান। যেটা এখনও বিদ্যমান। ছোট করা নয়, বরং বাস্তব তুলনা। এইচ জি ওয়েলস যখন ‘টাইম মেশিন’ (Time Machine, H. G. Wells) লেখেন তখন আমরা নজিবর রহমানের ‘প্রেমের সমাধি’ নিয়ে পড়ে থাকি। আর পেটে যদি থাকে ক্ষুধা, মনের মধ্যে থাকে সার্বক্ষণিক অবদমনের ত্রাস তাহলে দৈর্ঘ্য প্রস্হ যা ই হোক না কেন তাতে সৌন্দর্য ফুঁটবে না..! সর্বোপরি, প্রমান সাইজের একটা ডামিকে যত নিপাট করেই শাড়ি পড়ানো হোক না কেন, তা সুন্দর লাগতে পারে কিন্তু হৃদয় কারা আবেদন তাতে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। প্রবন্ধের আর একটি বিষয় আমার মনে যে প্রশ্নের উদ্রেক করে তা হলো, নারী-শাড়ির যুগল বন্দী নান্দনিকতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি যেন একটা সময়ে ওটাকে অতিক্রম করে শুধু রমনী দেহের আবেদনের (বলা যায় যৌনাবেদন) পথেই বিচরণ করেন। এ পর্যায়ে তার আদর্শে গড়া নারী সৌন্দর্যের জন্যে তিনি যে স্বপ্নের জাল বোনেন তাতে তাবৎ নারীরা জগৎ সংসারের অন্যসব গুণাবলীকে উপেক্ষা করে যেন সবাই ইন্দ্র সভার উর্বশী হয়ে যায়। এখানে অনেকে এক প্রকার পুরুষ তান্ত্রিক মানসিকতারই গন্ধ পায়। কিন্তু বঙ্গীয় নারীদেরকে অপরূপা করতে নারীর জীবনে শাড়ির ভূমিকা এবং সময় বা বাস্তবতার কারনে সস্তা আমদানিকৃত সংস্কৃতি ও কিছুটা গোঁড়া মূল্যবোধের ফলশ্রুতিতে হাজার বছরের পূরণ শিল্পীত এই পোশাকের ক্রমশঃ তিরোধানের যে পথ তৈরী হচ্ছে, তার আক্ষেপ গোটা প্রবন্ধেই পরিস্কার।
আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এখন সস্তা এবং গোঁড়ামিতে পূর্ণ সংস্কৃতি যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে তাতে করে এমন একটি প্রবন্ধ কে আমি স্বাগত ই জানাই। এখন সমস্যা হল, কারো কারো মতে এর সুরের মধ্যে বঙ্গ নারীদেরকে ছোট করে দেখার চিত্র ফুঁটে উঠেছে এবং যার অবয়বে পরোক্ষ ভাবে হলেও তারা একরকম পুরুষ তান্ত্রিক লালসার চিহ্ন দেখতে পায়। এটুকুই হয়তো গ্রহণ যোগ্য নয়। আবার কেউ কেউ (একটু রক্ষনশীল মানসিকতার) হয়তো শুধুমাত্র দিনের আলোর প্রেক্ষাপটে এটাকে কিছুটা অশ্লীল ও মনে করতে পারে। এটা কোন বড় বিষয় নয়। কারন রাতের আঁধারে এই শ্রেনীই হয়তো এটাকে নির্দিধায় পাশ করে দিবেন। যেটা আমাদের মনোজগতের আর এক প্রকার ভন্ডামির দিক। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটা আমাদের নারী সমাজের অনেকেরই আত্মমর্যাদা বোধ এবং আত্মশ্লাঘায় আঘাত হেনেছে। আর সেকারণেই প্রবন্ধটি এখন পত্রিকার পাতা ছেড়ে আকাশে বাতাসে উড়ছে..!
পৃথিবী ব্যাপি এখন চলছে নারী স্বাধীনতা, নারীর সমান অধিকারের বাক চর্চা (প্রকৃত অর্থে আন্দোলনের সামগ্রিক নিষ্ঠা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে)। কথাটা এভাবে বলছি কারন অনেক সময়ই আমরা বৃক্ষের শেকড়ের রোগকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাতার সমস্যা নিয়ে গলদ ঘর্ম হয়ে যাই..! এটা বর্তমানের এই শোবিজ সভ্যতার এক চমৎকার প্রহসন..! তবে সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে, মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নারীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে আমাদের মত পশ্চাৎপদ দেশ গুলোর জন্যে এটা অতীব জরুরী। এরপরে আমি যে কয়েকটি কথা বলবো তা হয়তো বেশীর ভাগ পাঠকের জন্যে গলধকরণ করা একটু কঠিন ই হতে পারে। তারপরও আমাকে বলতে হবে কারন তা না হলে আমার বোধ এবং চিন্তার কাছে নিজেই অসৎ হয়ে যাব।
নারীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো অন্তরায় গুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো আসে তা হলো-
১। সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত পুরুষদের প্রভূত্ব তান্ত্রিক মানসিকতা
২। সেই মানসিকতা থেকে উদ্ভুত সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসম বিন্যাস
৩। ধর্মীয় মূল্যবোধ ( গোঁড়ামি )।
আমরা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইদের প্রতিবেদন নিয়ে নারী পুরুষ নির্বিশেষে হৈচৈ এর শোর তুলেছি। অবশ্যই ভালো কথা। যে কোন প্রতিবেদনের চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। তবে যে বিষয় টা খারাপ লেগেছে তা হলো, এটি নিয়ে কিছু বাজে মন্তব্য। এই লোকটি তার দীর্ঘ কর্ম জীবনে সুস্হ সংস্কৃতি চর্চার জন্যে নিরলস যে কাজ করে গেছেন, আমাদেরকে যে নির্মল আনন্দ উপহার দিয়েছেন তার সবকিছুই যেন আমরা মূহুর্তে নাই করে দিলাম..! ওকে..আমাদের তারও অধিকার আছে। কয়েকদিন পূর্বে ডঃ সেলিম জাহানের লেখা একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম (সম্ভবত ধর্ষণ বহুমুখী বা এধরণের একটি নাম)। এ প্রবন্ধটি পড়তে গিয়েও আমার মনে হয়েছে তিনি একটা সুরঙ্গ পথের দৃষ্টিতেই (Tunnel Visioned) দেখছেন বিষয়টা। প্রবন্ধে ধর্ষণ শব্দটি এতোবার এতো বিরক্তিকর ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে যে এক পর্যায়ে মনে হয়েছে আমাদের বেশীর ভাগ পুরুষের চোখ, কান, নাক, মন সারাক্ষণ ধর্ষণের জন্যে ই উন্মুখ হয়ে থাকে। কোন নারীর দিকে তাকানো মানেই যেন কোন না কোন ভাবে ধর্ষণ। (আমিতো কোন সুন্দরী রমনী দেখলে বলেই ফেলি ঈশ্বর বসন্ত ছুটির দিনে ফুরফুরা মনে থেকে তাকে নিজ হাতে তৈরী করেছেন আর আমাকে বানানোর জন্যে সাব কনট্রাক্ট দিয়েছিলেন..!)। নাহ্ কোন হৈচৈ তো শুনিই নি, কোন সমালোচনাও নয়, বরং বেশ কিছু স্তুতি বাক্য, লাইক, লাভ সাইন চোখে পড়েছে। তাতে আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু নিজের মনে প্রশ্ন জেগেছে আসলেই কি আমরা সবাই মনে প্রাণে নারীদের ন্যায্য মর্যাদায় বিশ্বাসী না শুধু সময়ের সাথে তাল মেলাতে আর আপাতঃ ভাবে নিজেকে একটু উদার ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর নেয়ার জন্যে এগুলো করে যাচ্ছি। যদি সত্যিকারেই আমরা মনে প্রাণে এটি বিশ্বাস করি তবে এই দুই প্রতিবেদনের পাঠকের কাছেই এখন আমার দুটা প্রশ্ন (বিশেষ করে মুসলিম পাঠকদের কাছে) আছে। প্রথম প্রশ্নটা আমার বিবাহিত ভাই বোনদের কাছে। নারী পুরুষের মাঝে আমরা যখন সমান অধিকারের কথা বলি তখন সেটা আমাদের দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা জানি যে ধর্মীয় বিধান মতে বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে একজন স্বামী একই সাথে সর্বাধিক চার স্ত্রী এর সাথে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন। যে ভাই বোনেরা এ বিধানকে সমর্থন করেন তাদের কাছে প্রশ্ন রাখছি, যদি সেই একই শর্তের অধীনে আপনাদের স্ত্রীরা একই সাথে আপনি সহ আরও তিনজন স্বামীর সাথে তার দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে চান তাহলে কি আপনারা মেনে নিবেন? হ্যাঁ, বলতে পারেন পরিস্থিতি এমন হবেই না। এটা এক পাগলের প্রশ্ন। আবারও বলছি পরিস্থিতির দোহাই পরে। এবং পাগলের নয় এটা এক বিবেকের প্রশ্ন। আমি এটাও বলছি না যে আমাদের স্ত্রীদের এই অধিকারটা দিতে হবে। ওকে.. চারজন থেকে এবার আর একটু নীচের দিকে আসা যাক। একজন স্ত্রী যেমন শারীরিক বা অন্য কোন কারনে অক্ষম হতে পারে তেমনি একজন স্বামীও তো শারীরিক বা সেই একই কারনে অক্ষম হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত ঐ স্ত্রীকে কি পূর্ব স্বামীকে রেখেই আর একটা বিয়ে করার অনুমতি দিবেন? উত্তরটা না বলার পূর্বে একটু অপেক্ষা করুন। আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, এই কাজটিই আমরা পুরুষেরা গত হাজার বছর ধরে হর হামেশাই করে আসছি। অর্থাৎ যেটি আমরা নিজেদের জন্যে মেনে নিতে পারিনা সেই একই বিষয় আমরা আমাদের স্ত্রীদের মেনে নিতে বাধ্য করে আসছি অবলীলায়। একবারও ভেবে দেখিনা তার স্হানে যদি আমি হতাম তাহলে আমার কেমন লাগতো। পুরুষ তান্ত্রিক সমাজের দীর্ঘ পেষনে, ধর্মীয় ফতোয়ার অন্ধ গেরাকলে, অসহায়ত্বের দীর্ঘ পরিক্রমায় থেকে এখন তারাও এই বৈষম্যকে একরকম স্বাভাবিক ভবিতব্য হিসেবেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু যদি আমরা নিজেকে সত্যিকারের মুক্ত বিবেক বলে দাবী করি, সমতার কথা বলি, মানবতার কথা বলি তাহলে আমরা এ নিয়ে কেন প্রশ্ন করি না। কেন এ অচলায়তন ভাঙার প্রয়াসে নামিনা?
দ্বিতীয় প্রশ্নটার সাথে জড়িত অসম অর্থনৈতিক বিন্যাস। জড়িত আমাদের মা, বোন, স্ত্রী সবাই। পারিবারিক সম্পত্তি যখন ভাগ বাটোয়ারা করেন তখন একবার ও কি ভেবেছেন একই বাবা মায়ের সন্তান হয়েও এক বোন কেন এক ভাইয়ের অর্ধেক পাবে? যতটুকু জানি এটিও ইসলামিক বিধান। আর সমান অধিকারের ভিতটা আমরা তো ওখানেই গুড়িয়ে দেই। আমাদের নবীজী ১৪০০ বছর পূর্বে যে বিধানের কথা বলে গিয়েছেন সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে তা অবশ্যই আধুনিক এবং মানবিক এ নিয়ে কোন দ্বিতীয় প্রশ্ন নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা একবিংশ শতাব্দীর বিবেকের কাছে মানবতা আর সাম্যতার কথা বলছি। নারী অধিকারের বিষয়টিকেও নূতন ভাবে সংগায়িত করার তাগিদ অনুভব করছি। যদি এটা মেনে নিতে কেউ ব্যার্থ হন তবে সবার কাছেই সবিনয় অনুরোধ একবার নিজের মুখোমুখি হয়ে বুঝতে চেষ্টা করুন, কোন বিষয়টি হিমাচলের মত প্রতিরোধ হয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়ায়? ধর্মীয় বিশ্বাসের কারনে স্বর্গের লোভ, নরকের ভয় নাকি স্বার্থের খুঁটি হারিয়ে ফেলার আতংক? তবে কারন যেটাই হোক, একটা বিষয় আমি এখানেই পরিস্কার ভাষায় বলতে চাই, মুক্ত বিবেককে জিম্মি রেখে বা ধোঁকা দিয়ে, ধর্মীয় বোধ ও প্রথাগত ভাবে চলে আসা অসমতার ঘুণ পোকা মনের মধ্যে পোষণ করে নারী মুক্তির কথা আমরা যতই বলি না কেন, যতই গাই না কেন উদারতার গান, তেমন কোন লাভ হবে না। বরং নিজেদের সাথে হঠকারিতার অধ্যায়টাই শুধু দীর্ঘ হবে। একটা কিছু পেতে হলে অন্য আর একটা কিছু থেকে বেড় হয়ে আসতেই হয়। এটাই তো নিয়ম। শুরুতে ছিলো শুধু পেশীর দৌরাত্ম্য, পরবর্তীতে তার সাথে যোগ হয় মুদ্রার দৌরাত্ম্য। আদিম সমাজ থেকে আজ পর্যন্ত এই দুই দৌরাত্ম্যের জোড়ে আমাদের মগজের মধ্যে পুরুষ প্রভূত্ববাদের যে শেকড় এখন বৃক্ষ রূপ নিয়েছে তার থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে প্রয়োজন সব কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে মুক্ত মঞ্চে এসে দাঁড়ানো। আমরা তাতো করি ই না বরং ১৪০০ বছর পূর্বে আমাদের নবী যা বলে গেছেন সেটুকুও সঠিক ভাবে অনুধাবন এবং পালন করতে শুধু ব্যর্থই হচ্ছি না, ফতোয়ার আকারে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে আবারও অন্ধকার কূপে ঠেলে দিচ্ছি।
নারীর অংগে শাড়ি..! আহ্.. কি উচ্ছলতা.. কি বিষণ্ণতা.. কি মাদকতা..! শব্দে মিল, ছন্দে মিল, সৌন্দর্যে সে যেন বসন্ত প্রকৃতির অবয়বে পূর্ণ শশীর ধারা..! এই দুইয়ের সম্মিলন ছাড়া আমাদের সমাজ চিত্রের কোন নান্দনিকতাই যেন পূর্ণতা পায় না। কত গল্প, কত উপন্যাস, কত কাব্য, কত সংগীত, কত ভালোবাসা, কত বিরহ-ব্যাথা..! আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে কত ভাবে, কত রূপে, কত আবেগের ছোঁয়ায় জড়িয়ে আছে এই নারী আর শাড়ির উপাখ্যান। কখনো প্রেয়সীর কামুকতায়, কখনো মায়ের মমতায়, কখনো সমাজ সংসারের প্রধান ব্যক্তির ভূমিকায় হয় তার আবির্ভাব। এ নিয়ে লিখতে না পারলে তো আমাদের কলমই ছেঁড়ে দিতে হবে। আর সেই লেখার মধ্যে একটু এদিক সেদিক তো হতেই পারে। কলমকে খোঁয়াড়ের ভিতরে আটকে রেখে আর যা ই হোক শিল্পের চাষ হয় না। এখানে শিল্প স্রষ্টার মনের অনুভূতিটাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। তারপর সমালোচনা। নিজের গীত গাওয়া নয়। প্রাসংগিক হতে পারে বলেই এখানে আমার লেখা দুটো লাইনের উল্লেখ করতে চাই “বহু বহুদিন আগের সেই অচলার মত নারী.. সমৃদ্ধ খোপার প্রদেশ ঘুরিয়ে অধরে লুফে নেয়া আঁচলের খুঁট.. সেই অচলা..” (কবিতা- বিনোদ ভালো আছে)। এখানে নারীর সৌন্দর্য বর্ণনায় শুধু তার খোপার উল্লেখ করা হয়েছে। তার সাথে অনুসংগ হিসেবে এসেছে পরিহিত শাড়ির একটি বিশেষ ভঙ্গিমা। যা আমাদের কাছে একটি বিশেষ মুহূর্তের চিত্রকে তুলে ধরে। অচলা-বিনোদের সংসারে অচলাই যে প্রধান চরিত্র, কবিতার অবয়বে আমি সেটাকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তার অকাল মৃত্যুতে বিনোদের জীবন-সংসার তছনছ হয়ে যায়। তাই প্রায় জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে ও বিনোদ তার পরাবাস্তব স্বপ্নে, তার হ্যালোসিনেশনে অচলাকে দেখে। সমরেশ মজুমদারের কালবেলা উপন্যাসে মাধবীলতার চরিত্রটিও আমাকে খুবই মুগ্ধ করে। যেখানে সে সমাজ কুসংস্কারের সব রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে তার আর অনিমেষের উত্তরসুরী (সন্তানদের আমি শুধু পুরুষদের উত্তরসুরী ভাবিনা, এটা আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস) অর্ককে বড় করে, মানুষ করে। এমন উদাহরণ, এর বিপরীত উদাহরণ, সাহিত্যের পরিমন্ডলে এর কোনোটিরই তো কমতি নেই। কিন্তু ক্লান্ত..। নিশ্চিত, পাঠকেরা আরও বেশী ক্লান্ত। সুতারং এখন ঘুমোবার সময়। তার পূর্বে আর একবার…
বঙ্গীয় রমনীদের অংগে শাড়ি..
সেতো..
আমার উদাসী মনের পবনে উড়তে থাকা
ভালোবাসার গৈরিক নিশান..!!
ফরিদ তালুকদার । টরেন্টো, কানাডা
সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৯
এখনও কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্যটি করুন!